Thursday, 31 July 2025

চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি?

 প্রশ্ন - ১২: চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি?

উত্তর: বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ বা চর্যাগীতি। চর্যাপদের পদগুলোর সাহিত্য মূল্য এবং সাহিত্যের অন্তরালে গূঢ় দার্শনিক তত্ত্বের গুরুত্ব অসামান্য। মূলত বৌদ্ধ সাধন-ভজন সম্পর্কিত নানা বিষয় চর্যাগীতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন পণ্ডিতগণ। এগুলো বিভিন্ন সময়ে রচিত হলেও একত্রে সংকলন করা হয়েছে। সহজিয়া দর্শনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়।

চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন : বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি সম্প্রদায় হলো সহজযান সম্প্রদায়, যাদের মতবাদকে সহজিয়া মতবাদ বলা হয়ে থাকে। চর্যাপদের মাধ্যমে তারা তাদের ধর্ম সাধনার নিগূঢ় পদ্ধতি ও বাণীর সাংকেতিকভাবে প্রকাশ করেছেন যা দার্শনিক তত্ত্বে ভরপুর। চর্যাপদের মূল বিষয়বস্তু হলো: সহজযান সম্প্রদায়ের ধর্মের বা সহজিয়া ধর্মের মোক্ষ | লাভের সাধন পদ্ধতির বর্ণনা; উপায় এবং তাত্ত্বিকতার আলোচনা।

বৌদ্ধ সহজযান সম্প্রদায়ের সাধকগণ নিজেদের সহজিয়া বলে। পরিচয় দেন। তাদের রচিত দর্শনই সহজিয়া দর্শন। সহজিয়াদের সাধ্য ও সাধনা অন্যান্য বৌদ্ধ সম্প্রদায় অপেক্ষা সহজ। তারা মনে করে। প্রত্যেক সত্তারই একটি সহজ স্বরূপ আছে, যা সর্বাবস্থায় সহজ থাকে। এ সহজ স্বরূপকে উপলব্ধিতে এনে মহাসুখে বা পরমানন্দে থাকাই সহজিয়াদের মূল লক্ষ্য। এটিই সহজিয়াদের মোক্ষ বা নির্বাণের স্বরূপ। তারা যে সাধন পদ্ধতির কথা চর্যায় বিবৃত করেছেন তা ছিল সহজ-সরল। যেমন- ৩২নং চর্যায় বলা হয়েছে-

"উজুরে উজু ছাড়ি মা জাহুরে বঙ্গ।

 নিয়ড়ি বহি মা জাহুরে লঙ্গ." 

"এ পথ সোজা, সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে যেও না; বোধি নিকটই আছে, লঙ্কায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই।"

উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চর্যাপদের দর্শনতত্ত্ব মানেই বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শন। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন সম্প্রদায়ের ধর্মসাধনার নিগূঢ় পদ্ধতি ও বাণী সাংকেতিকভাবে বহন করে চর্যাপদ রচিত। নির্বাণ লাভের সহজ সরল পন্থা বর্ণিত হয়েছে চর্যার বিভিন্ন পদে।

অতীশ দীপঙ্করের দর্শন সম্পর্কে লিখ। অথবা, অতীশ দীপঙ্করের দর্শন সম্পর্কে কি জান? সংক্ষেপে লিখ।'

প্রশ্ন- ১১: অতীশ দীপঙ্করের দর্শন সম্পর্কে লিখ।

অথবা, অতীশ দীপঙ্করের দর্শন সম্পর্কে কি জান? সংক্ষেপে লিখ।'


উত্তর : হিন্দু যুগের শেষ অধ্যায়ের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রেষ্ঠ বাঙালি দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক হলেন অতীশ দীপঙ্কর। তিব্বতি সূত্র অনুযায়ী অতীশ দীপঙ্কর বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম হলো চন্দ্র গর্ভ।

অতীশ দীপঙ্করের দর্শন: মাত্র উনিশ বছর বয়সে অতীশ দীপঙ্কর ওদন্তপুরী মহাবিহারের আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট হতে শ্রমন লাভ করেন। আচার্য তাঁকে শ্রীজ্ঞান নামে নতুন নাম প্রদান করেন। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে, তিনি মগধের ধর্মক্ষিতের নিকট গিয়ে বোধিসত্ত্বদের প্রতিপাদ্য বিষয়ে শিক্ষা নিতে শুরু করেন। এবং অতি অল্প সময়েই তিনি বোধিসত্ত্বদের প্রতিপাদ্য চর্যাধ্যান ইত্যাদি অনুশীলন করে সাধনার উচ্চশিখরে আরোহণ করেন। বোধি সত্ত্বের কঠোর ব্রতে দীক্ষিত দীপঙ্করের সাফল্য দেখে আচার্য ধর্মরক্ষিত তাঁকে ভিক্ষুধর্মের শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন। মগধের প্রখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিতগণের নিকট অতীশ দীপঙ্কর -অধিবিদ্যা জ্ঞান ও বস্তুর বিবর্তনবাদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষিত হবার পর অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশীলা বিহারেই অবস্থান করেন। সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি প্রতিরূপে খ্যাতিলাভ করেন। কিন্তু আজীবন জ্ঞানতৃষ্ণায় তৃষিত দীপঙ্করের জ্ঞানের স্পৃহা কিছুতেই নিবৃত্ত হলো না, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। তিনি গুরু চন্দ্র কীর্তির অধীনে চার বছরকাল অতিবাহিত করে গৌতম বুদ্ধের বিশুদ্ধ শিক্ষার উপর সুগভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেন। তিব্বত গমনের পূর্ব পর্যন্ত অতীশ দীপঙ্কর বিক্রম শীলের প্রধান আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এই বিহার থেকেই অতীশ দীপঙ্কর তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'বোধি পথ প্রদীপ' রচনা করেন। এই গ্রন্থ থেকেই তার সমস্ত তত্ত্বদর্শনের ইস্পিত পাওয়া যায়।

উপসংহার: পরিশেষ আমরা বলতে পারি যে, অতীশ দীপঙ্করের দর্শন ছিল মূলত ধর্মীয় জ্ঞান আহরণভিত্তিক। তিনি আজীবন ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও ধর্মসাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তিতে তার অনেক সমালোচনা উপস্থাপিত হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের যে চেষ্টা তিনি করেছেন তা তাঁকে চিরকাল অবিস্মরণীয় করে রাখবে।

অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা কর।

প্রশ্ন - ১০: অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: প্রাচীন বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ও মননচিন্তার বিবর্তনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশুদ্ধ মহাযানী বৌদ্ধমতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও দার্শনিক হলেন অতীশ দীপঙ্কর (৯৮০-১০৫৩ খ্রি.)। বলা হয় দশম শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা আলোকদীপ্ত ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এবং 'বাঙালি' বৌদ্ধ মহাচার্যদের মধ্যে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান শ্রেষ্ঠতম। আর সমগ্র ভারতবর্ষের পণ্ডিত ও দার্শনিকদের মধ্যে তিনি। উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। তাঁর ধর্ম সাধনা কেন্দ্রীভূত ছিল মানব কল্যাণে। তাই মানবতাবাদী তত্ত্বই তাঁর দার্শনিক রচনার মুখ্য বিষয়রূপে প্রতিভাত হয়েছে। প্রত্যেককে বুদ্ধের সমগ্র শিক্ষা অনুশীলন করতে হবে এটাই তাঁর দর্শনের মূলমন্ত্র ছিল।

অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা: অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধধর্মকে অবক্ষয় থেকে পুনরুদ্ধার করেন এবং এ ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। তিনি মহাযান মতের - শূন্যতাবাদ, বিজ্ঞানবাদ, মানবতাবাদী মৈত্রীভাবের অখণ্ডতা তুলে ধরে বৌদ্ধধর্মকে কলুষমুক্ত করে এক নতুন ধর্ম ও দর্শন প্রচার করেন। বিক্রমশীলা বিহারে ভিক্ষুগণ তখন নানা প্রকার নৈতিক ও মানসিক শৈথিল্যে ভারগ্রস্ত ছিল। দীপঙ্কর তাঁর অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি ও শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা এসব পদস্খলনিত ভিক্ষুদের নৈতিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। সেসময়কার বিক্রমশীলা বিহারের অধিনায়ক আচার্য রত্নাকর তিব্বতি দূত আচার্য বিনয়ধরের নিকট যে উক্তি করেন তা থেকে দীপঙ্করের মানসিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। তিনি বলেছিলেন- "অতীশ না থাকিলে ভারতবর্ষ অন্ধকার। বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কুঞ্চিকা তাঁহারই হাতে। তাহার অনুপস্থিতি এসব প্রতিষ্ঠান শূন্য হইয়া যাইবে।”

সে সময় তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম ছিল আরো নাজুক অবস্থায়। চারদিকে দেখা গিয়েছিল ধর্মীয় অনাচার ও অনিয়ম। ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞের অভাবে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের আদর্শ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। দীপঙ্কর তিব্বতে গমন করার পর সারা তিব্বতের প্রধান প্রধান শহর, গ্রাম এবং পীঠস্থান ভ্রমণ করে তিনি নিরলসভাবে ধর্মের প্রচার চালাতে থাকেন। তাঁর বিপুল পাণ্ডিত্য এবং অসাধারণ বাগ্মিতায় সেদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তাঁরা তাদের হারানো ধর্মীয় বিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে।

অতীশ দীপঙ্কর নিজেও তান্ত্রিক দীক্ষায় দীক্ষিত হন। রাহুল গুপ্তের নিকট হতে এ দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় 'গুহ্য জ্ঞানবজ্র' তান্ত্রিক তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে তাঁর পক্ষে তন্ত্রের কঠোরতা ও সংযম সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করা সম্ভবপর হয়েছিল। তবে ভিক্ষুরূপে বৌদ্ধসংঘে দীক্ষা গ্রহণের পর, তিব্বতি সূত্রে জানা যায়, শাক্যমুনি বুদ্ধের আদেশে দীপঙ্কর বজ্রযান ত্যাগ করে মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরূপে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। এ কারণেই তিনি 'দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান' নামে অধিক পরিচিত।

পূবেই বলা হয়েছে মহাযানী বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রে আছে 'বোধিসত্ত্ব'র ধারণা। আর বোধিসত্ত্বের পর্যায়ে তিনি যেতে পারেন যিনি কুশলকর্ম ও সদাচার অনুষ্ঠান দ্বারা নিজের মুক্তিকে অগ্রাহ্য করে অন্যের মুক্তি তথা বিশ্বের কল্যাণ কামনায় আত্মোৎসর্গ করতে এবং অগণিত মানুষের দুঃখের বোঝা গ্রহণ করতে দৃঢ়সংকল্প। অতীশ দীপঙ্কর মহাযান মৃতের এই মৈত্রীভাবাপন্ন ও মানবতাবাদী দিকটিকে শীর্ষে স্থান দেন। সর্বপ্রকার সংযমের মাধ্যমে মানবতার এই শীর্ষবিন্দুতে পৌছানোই ছিল দীপঙ্করের লক্ষ্য। তাঁর বিশ্বাস এ পথে সফলতা পেলেই বৌদ্ধধর্ম তার স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর মতে, ধর্মীয় জীবনযাপনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম, ধৈর্যধারণ ও আত্মশুদ্ধি। 'সর্বজগতের সর্বপ্রাণীর সব দুঃখ দূর করার জন্য বুদ্ধ হবো' এরূপ সংকল্প এবং এ সংকল্প সাধনের জন্য যে প্রাণরূপ প্রয়াস সেটাই সাধককে 'বোধিসত্ত্ব' লাভ করতে সহায়ক হয়। মহাযানী বৌদ্ধমতের এটাই মূল লক্ষ্য। দীপঙ্কর সকল বিপত্তি অতিক্রম করে তাঁর অপ্রমেয় মৈত্রী বলে তিব্বতের বিপথগামী মানুষদের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ কামনাই অতীশের এই বাণীতে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের মৈত্রী ও করুণার কথা ধ্বনিত হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই বলেছেন, "চরিত্রে, পাণ্ডিত্যে মনীষায় ও অধ্যাত্ম গরিমায় দীপঙ্কর সমসাময়িক বাংলার ও ভারতবর্ষের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। পূর্ব ভারত ও তিব্বতের মধ্যে যাঁহারা মিলনসেতু রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে দীপঙ্করের নাম সর্বাগ্রে এবং সকলের পুরোভাগে স্মর্তব্য।"

সংক্ষেপে শান্তিদেব দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর।

প্রশ্ন- ৯ :সংক্ষেপে শান্তিদেব দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তরা: বৌদ্ধ মহাযান ধারার দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক শান্দিদেব সঠিক জন্ম পরিচয় এবং মৃত্যুক্ষণ জানা যায়নি। জন শ্রুতি আছে যে, তিনি রাজপুত্র ছিলেন। তারাদেবীর অনুপ্রেরণায় তিনি রাজ্য পরিত্যাগ করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবনবরণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে শিক্ষা সমুচ্চয়, বোধি, চর্যাবতার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।

শান্তিদেবের দর্শন: শান্তিদেব তার শিক্ষা সমুচ্চয় গ্রন্থে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের মতবাদ সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন এবং বোধি চর্যাবতার গ্রন্থে তিনি আলোচনা করেছেন। বুদ্ধত্ববাদী ব্যক্তির জীবনাদর্শ।

জাগতিক বিষয়ভাবনা: শান্তিদেব তাঁর বিভিন্ন রচনায়। মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের অসারতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন এবং বলেছেন যে, সুখ-দুঃখ, অনুরাগ, বিরাগ, লাভ-ক্ষতি সবই অবাস্তব। তাই মানুষের দায়িত্ব হলো অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে পার্থিব জীবনের দুদর্শা হতে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করা।

মানবতাবাদী চিন্তা: শান্তিদেব রচিত বোধি চর্যাবতার মানবতার সাধনা বিষয়ে বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তার বিকাশে ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এ গ্রন্থের প্রতি পরতে পরতে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

মৈত্রীর জয়গান : শান্তিদেব বলেছেন, পৃথিবীতে অশুভ বা অন্যায় অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। এর শক্তি প্রবল। এই ভয়ঙ্কর অন্যায় শক্তিকে জয় করার ক্ষমতা কোন ব্যক্তির নেই। এক জয় করতে পারে কেবল মৈত্রী।

প্রজ্ঞা পারমিতা ব্যাখ্যা কর। অথবা, প্রজ্ঞা পারমিতা বলতে শান্তিদেব কী বুঝিয়েছেন?

প্রশ্ন- ৮: প্রজ্ঞা পারমিতা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, প্রজ্ঞা পারমিতা বলতে শান্তিদেব কী বুঝিয়েছেন?

উত্তর:

ভূমিকা : মানবতার পূর্ণ বিকাশে বৌদ্ধদর্শনে যে সাধনা বা অনুশীলন বা চর্চার কথা বলা হয়ে থাকে তার নাম ষটপারমিতা। পরিমিতা শব্দের অর্থ যা সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়েছে। পালি বৌদ্ধ শাস্ত্রে দশ পারমিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মহাযান বৌদ্ধদর্শনে দশ পারমিতার স্থলে ছয় পারমিতার কথা বলা হয়েছে। এ ছয়টি পারমিতা মহাযান বৌদ্ধধর্ম দর্শনে ঘটপারমিতা নামে পরিচিত। এ ষটপারমিতার সর্বশেষ স্তর হলে। প্রজ্ঞা পারমিতা।

প্রজ্ঞা পারমিতা : ধ্যান ও প্রজ্ঞা- এ দুটির সম্মিলিত চর্চার মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যেতে পারে। পূর্বোক্ত পঞ্চবিধ ষটপারমিতার শেষোক্তটি হলো ধ্যান পারমিতার অনুশীলন বা চর্চার দ্বারা সাধক জগতের সমস্ত রহস্য ও অজানা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে। সাধক যে কোন বিষয় প্রজ্ঞা পারমিতার চর্চা দ্বারা সত্য উদঘাটন ও অনুধাবন করতে পারে। সাধক দিব্য জ্ঞানলাভ করতে পারে প্রজ্ঞা পারমিতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং সাধকের কাছে বুদ্ধত্ব ও ইহত্বের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

শান্তিদেব প্রজ্ঞা পারমিতা সম্পর্কে বলেন, পঞ্চ পারমিতার সাধনা দ্বারা ভক্তের মাঝে প্রজ্ঞার উদয় হয়। তবে দুঃখাদি বাসনা, পরোপকার মর্ষণ, ধর্মনিধ্যান, বীর্য ও ধ্যান এ পঞ্চবিধ পারমিতার সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল অনুশীলন ছাড়া প্রজ্ঞা বা জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। এ পঞ্চ পারমিতার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রজ্ঞা পারমিতা অর্জন সম্ভব।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ষটপারমিতার সর্বশেষ স্তর হলো প্রজ্ঞা পারমিতা। পঞ্চ পারমিতার চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমেই প্রজ্ঞা পারমিতার জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। সুতরাং প্রজ্ঞা পারমিতা বৌদ্ধদর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

শান্তিদেবের বোধিচর্যা সংক্ষেপে লিখ। অথবা, শান্তিদেবের যটপারমিতা বলতে কী বুঝিয়েছেন?

প্রশ্ন - ৭: শান্তিদেবের বোধিচর্যা সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, শান্তিদেবের যটপারমিতা বলতে কী বুঝিয়েছেন?


উত্তরা:

ভূমিকা: বাঙালি দর্শনের মধ্যে বৌদ্ধদর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন। এ দর্শনের মধ্যে যে কয়জন বাঙালি বৌদ্ধ দার্শনিক প্রভাব বিস্তার করেছেন তাদের মধ্যে শান্তিদেব ছিলেন। অন্যতম। তিনি ছিলেন মহাযান সম্প্রদায়ের একজন ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক। তিনি যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন তার অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে 'শিক্ষা সমুচ্চয়' ও 'বোধিচর্যাবতার' প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ।

 শান্তিদেবের বোধিচর্যা বা ষটপারমিতা শান্তিদেবের মতে, মানবতার পূর্ণ বিকাশে বৌদ্ধদর্শনে যে সাধনা বা চর্চার কথা বলা হয়ে থাকে তার নাম ষটপারমিতা। পারমিতা শব্দের অর্থ যা পারে গিয়েছে অর্থাৎ যা সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়েছে। পালি বৌদ্ধ শাস্ত্রে দশ পারমিতার কথা বলা হয়েছে কিন্তু বৌদ্ধদর্শনে দশ পারমিতার স্থলে ছয় পারমিতার কথা বলা হয়েছে। এ ছয়াট পারমিতা মহাযান বৌদ্ধধর্ম দর্শনে ষটপারমিতা নামে পরিচিত। নিম্নে ঘটপারমিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. দান পারমিতা: মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। স্বার্থপর ব্যতীত মানুষ পাওয়া খুবই কষ্টকর। মানুষ সবসময় অন্যের ভালোর কথা চিন্তা না করে নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে। কিন্তু দান পারমিতার লক্ষ্য হলো সাধকের নিজের মধ্যে যা কিছু আছে তার বিনিময়ে কোন কিছুর আশা না করে তাপরের কল্যাণে বা মঙ্গলে তা বিলিয়ে দেয়া।

২. শীল পারমিতা: পৃথিবীতে সবসময় দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই রয়েছে। এ দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে উত্তরের পথ বের করার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বের এ যাবতীয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও অশান্তির মূল কারণ হলো পঞ্চবিধ। এ পঞ্চবিধ পাপকার্য হলো- প্রাণী-হিংসা হতে বিরত, পরস্বাপহরণ হতে বিরত, ব্যভিচার হতে বিরত, মিথ্যা বলা হতে বিরত, মাদকদ্রব্য সেবন হতে বিরত।

৩. ক্ষান্তি পারমিতা: মানুষ ক্ষমতাশীল। ক্ষমার দৃষ্টিতে মানুষ সবকিছু দেখে থাকে। তাই ক্ষান্তি পারমিতার লক্ষ্য হলো ক্ষমাশীলতার অনুশীলন করা। মানব সমাজে একে অপরের প্রতি হিংসা, মারামারি, কাটাকাটি হতে বিরত থাকাই হলো ক্ষান্তি পারমিতা।

৪. বীর্য পারমিতা: মহাযান বৌদ্ধ দর্শনে কুশল-কর্মে উৎসাহকেই বলা হয় বীর্য। বীর্য পারমিতার লক্ষ্য হলো কুশল বা শুভ ও মঙ্গলের প্রতি উৎসাহ লাভ করা। বীর্যের প্রতিপক্ষ হচে আলস্য, কুৎসিত বিষয়ে আসক্তি, বিষাদ, নিজের প্রতি অবিশ্বাস।

৫. ধ্যান পারমিতা: বৌদ্ধদর্শনে বুদ্ধত্ব লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ধ্যান বা সাধনা করা। সাধক ধ্যানমগ্ন হয়ে সাধনা করে দিব্য জ্ঞানলাভ করতে পারে। জগতের জাগতিক বস্তুরাজি এবং সমস্ত কিছু তিনি এ জ্ঞান দ্বারা বুঝাতে পারেন। সাধক সবসময় নির্জন স্থানে ধ্যানমগ্ন হবেন এটিই খ্যান পারমিতার লক্ষ্য।

৬. প্রজ্ঞা পারমিতা : ধ্যান ও প্রজ্ঞা এ দুটির সম্মিলিত চর্চা দ্বারাই নির্বাণ লাভ করা যেতে পারে। পূর্বোক্ত পঞ্চবিধ ষটপারমিতার শেষোক্তটি হলো পারমিতার অনুশীলন বা চর্চার দ্বারা- সাধক জগতের সমস্ত রহস্য ও অজানা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শান্তিদেবের ষটপারমিতার সাধনা দ্বারা সম্যক জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয়। শান্তিদেবের ষটপারমিতাই হলো বৌদ্ধদর্শনে মানবতাবাদের নির্দেশক। একজন সাধক যদি ভার ছয়টি গুণ অর্জন করতে সমর্থ হয় তাহলেই সে সফলতা অর্জন করতে পারে।


শান্তিদেবের মানবতাবাদী মতের ব্যাখ্যা দাও। অথবা, শান্তিদেবের মানবতাবাদী দর্শন সংক্ষেপে লিখ।

 প্রশ্ন - ৬: শান্তিদেবের মানবতাবাদী মতের ব্যাখ্যা দাও।

অথবা, শান্তিদেবের মানবতাবাদী দর্শন সংক্ষেপে লিখ।


উত্তর:

ভূমিকা: প্রগতিশীল বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে মহাযান সম্প্রদায় অত্যন্ত উদারপন্থি ও মানবতাবাদী সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়ের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক শান্তিদেব (আনুমানিক ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮১৬ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন বুদ্ধত্বকামী মানুষের আদর্শস্বরূপ। তিনি বলেন, সথ দুঃখ, অনুরাগ বিবাগ, লাভক্ষতি সবই অবাস্তব। তিনি তাঁর 'বোধিচর্যাবতার' গ্রন্থে মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের অনুসরণে জাগতিক সবকিছুর অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে মানবতাবাদী দর্শন আলোচনা করেছেন।

শান্তিদবের মানবতাবাদী দর্শন: শান্তিদেব রচিত 'বোধিচর্যাবতার' গ্রন্থটি মানবতার সাধনায় বাঙালির মানবতাবাদী দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ কিভাবে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে ব্যাপারে যে কয়জন মনীষী আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে শান্তিদেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতি হিসেবে বাঙালি কতটা উদার ও মানবতাবাদী তার প্রকৃত প্রমাণ পাওয়া যায় শান্তিদেবের 'বোধিচর্যাবতার' গ্রন্থে। এ গ্রন্থ তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। এ গ্রন্থে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। এ গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন ভাষায় অর্থাৎ তিব্বতীয়, মঙ্গোলীয় ও চীনা এ তিনটি ভাষার অনূদিত হয়। আবার আধুনিক কালে ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়েছে।

শান্তিদেবের 'বোধিচর্যাবতার' দার্শনিক গ্রন্থ হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত হয়। এর মূল কারণ হলো শান্তিদেবের দর্শনের মানবিক মূল্যবোধ। মানুষের জীবনে মানবতাবাদ শান্তিদেবের দর্শনেই ফুটে উঠেছে। তিনি তাঁর বিখ্যাত 'বোধিচর্যাবতার' গ্রন্থে বলেছেন, "পৃথিবীতে অশুভ বা অন্যায় অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে আছে, যার শক্তি প্রবল। বহু প্রকার শুভ প্রচেষ্টাও অবশ্য পৃথিবীতে রয়েছে। কিন্তু ঐ ভয়ংকর অন্যায়কে জয় করার ইচ্ছা কারো নেই। তাকে জয় করতে পারে মৈত্রী। পরলোক, মোক্ষ বা নির্বাণ তো দূরের কথা, এটি না থাকলে সংসারই যে অচল হয়ে যায়।" এ উক্তিটিতে মৈত্রীর পক্ষে শান্তিদেবের সমর্থন তাঁর মানবতাবাদী মনেরই পরিচয় বহন করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শান্তিদেব ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। সমাজের মানুষের মধ্যে অন্যায়, অবিচার, ভেদাভেদ কখনো তাঁর মানবতাবাদ স্বীকার করে না। শান্তিদেব মনে করেন, সমাজের মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। একজনের দুঃখে অন্যজন এগিয়ে আসবে। একজনের সুখে অন্যজন সুখী হবে। এটিই বাস্তবতা বলে শান্তিদেব মনে করেন। সুতরাং তার মানবতাবাদী দর্শনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি?

 প্রশ্ন - ১২: চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি? উত্তর: বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ বা চর্যাগীতি। চর্যাপদের পদগুল...