Thursday, 31 July 2025

অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা কর।

প্রশ্ন - ১০: অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: প্রাচীন বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ও মননচিন্তার বিবর্তনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশুদ্ধ মহাযানী বৌদ্ধমতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও দার্শনিক হলেন অতীশ দীপঙ্কর (৯৮০-১০৫৩ খ্রি.)। বলা হয় দশম শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা আলোকদীপ্ত ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এবং 'বাঙালি' বৌদ্ধ মহাচার্যদের মধ্যে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান শ্রেষ্ঠতম। আর সমগ্র ভারতবর্ষের পণ্ডিত ও দার্শনিকদের মধ্যে তিনি। উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। তাঁর ধর্ম সাধনা কেন্দ্রীভূত ছিল মানব কল্যাণে। তাই মানবতাবাদী তত্ত্বই তাঁর দার্শনিক রচনার মুখ্য বিষয়রূপে প্রতিভাত হয়েছে। প্রত্যেককে বুদ্ধের সমগ্র শিক্ষা অনুশীলন করতে হবে এটাই তাঁর দর্শনের মূলমন্ত্র ছিল।

অতীশ দীপঙ্করের দার্শনিক চিন্তাভাবনা: অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধধর্মকে অবক্ষয় থেকে পুনরুদ্ধার করেন এবং এ ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। তিনি মহাযান মতের - শূন্যতাবাদ, বিজ্ঞানবাদ, মানবতাবাদী মৈত্রীভাবের অখণ্ডতা তুলে ধরে বৌদ্ধধর্মকে কলুষমুক্ত করে এক নতুন ধর্ম ও দর্শন প্রচার করেন। বিক্রমশীলা বিহারে ভিক্ষুগণ তখন নানা প্রকার নৈতিক ও মানসিক শৈথিল্যে ভারগ্রস্ত ছিল। দীপঙ্কর তাঁর অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি ও শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা এসব পদস্খলনিত ভিক্ষুদের নৈতিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। সেসময়কার বিক্রমশীলা বিহারের অধিনায়ক আচার্য রত্নাকর তিব্বতি দূত আচার্য বিনয়ধরের নিকট যে উক্তি করেন তা থেকে দীপঙ্করের মানসিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। তিনি বলেছিলেন- "অতীশ না থাকিলে ভারতবর্ষ অন্ধকার। বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কুঞ্চিকা তাঁহারই হাতে। তাহার অনুপস্থিতি এসব প্রতিষ্ঠান শূন্য হইয়া যাইবে।”

সে সময় তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম ছিল আরো নাজুক অবস্থায়। চারদিকে দেখা গিয়েছিল ধর্মীয় অনাচার ও অনিয়ম। ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞের অভাবে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের আদর্শ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। দীপঙ্কর তিব্বতে গমন করার পর সারা তিব্বতের প্রধান প্রধান শহর, গ্রাম এবং পীঠস্থান ভ্রমণ করে তিনি নিরলসভাবে ধর্মের প্রচার চালাতে থাকেন। তাঁর বিপুল পাণ্ডিত্য এবং অসাধারণ বাগ্মিতায় সেদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তাঁরা তাদের হারানো ধর্মীয় বিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে।

অতীশ দীপঙ্কর নিজেও তান্ত্রিক দীক্ষায় দীক্ষিত হন। রাহুল গুপ্তের নিকট হতে এ দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় 'গুহ্য জ্ঞানবজ্র' তান্ত্রিক তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে তাঁর পক্ষে তন্ত্রের কঠোরতা ও সংযম সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করা সম্ভবপর হয়েছিল। তবে ভিক্ষুরূপে বৌদ্ধসংঘে দীক্ষা গ্রহণের পর, তিব্বতি সূত্রে জানা যায়, শাক্যমুনি বুদ্ধের আদেশে দীপঙ্কর বজ্রযান ত্যাগ করে মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরূপে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। এ কারণেই তিনি 'দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান' নামে অধিক পরিচিত।

পূবেই বলা হয়েছে মহাযানী বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রে আছে 'বোধিসত্ত্ব'র ধারণা। আর বোধিসত্ত্বের পর্যায়ে তিনি যেতে পারেন যিনি কুশলকর্ম ও সদাচার অনুষ্ঠান দ্বারা নিজের মুক্তিকে অগ্রাহ্য করে অন্যের মুক্তি তথা বিশ্বের কল্যাণ কামনায় আত্মোৎসর্গ করতে এবং অগণিত মানুষের দুঃখের বোঝা গ্রহণ করতে দৃঢ়সংকল্প। অতীশ দীপঙ্কর মহাযান মৃতের এই মৈত্রীভাবাপন্ন ও মানবতাবাদী দিকটিকে শীর্ষে স্থান দেন। সর্বপ্রকার সংযমের মাধ্যমে মানবতার এই শীর্ষবিন্দুতে পৌছানোই ছিল দীপঙ্করের লক্ষ্য। তাঁর বিশ্বাস এ পথে সফলতা পেলেই বৌদ্ধধর্ম তার স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর মতে, ধর্মীয় জীবনযাপনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম, ধৈর্যধারণ ও আত্মশুদ্ধি। 'সর্বজগতের সর্বপ্রাণীর সব দুঃখ দূর করার জন্য বুদ্ধ হবো' এরূপ সংকল্প এবং এ সংকল্প সাধনের জন্য যে প্রাণরূপ প্রয়াস সেটাই সাধককে 'বোধিসত্ত্ব' লাভ করতে সহায়ক হয়। মহাযানী বৌদ্ধমতের এটাই মূল লক্ষ্য। দীপঙ্কর সকল বিপত্তি অতিক্রম করে তাঁর অপ্রমেয় মৈত্রী বলে তিব্বতের বিপথগামী মানুষদের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ কামনাই অতীশের এই বাণীতে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের মৈত্রী ও করুণার কথা ধ্বনিত হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই বলেছেন, "চরিত্রে, পাণ্ডিত্যে মনীষায় ও অধ্যাত্ম গরিমায় দীপঙ্কর সমসাময়িক বাংলার ও ভারতবর্ষের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। পূর্ব ভারত ও তিব্বতের মধ্যে যাঁহারা মিলনসেতু রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে দীপঙ্করের নাম সর্বাগ্রে এবং সকলের পুরোভাগে স্মর্তব্য।"

No comments:

Post a Comment

চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি?

 প্রশ্ন - ১২: চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি? উত্তর: বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ বা চর্যাগীতি। চর্যাপদের পদগুল...