Wednesday, 30 July 2025

দর্শনে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের গুরুত্ব লিখ। অথবা, বাঙ্গালি দর্শনে লোকায়ত বা কাবার্ক দর্শনের গুরুত্ব কী?

প্রশ্ন - ৩: দর্শনে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের গুরুত্ব লিখ।

অথবা, বাঙ্গালি দর্শনে লোকায়ত বা চাবার্ক দর্শনের গুরুত্ব কী?


উত্তর:

ভূমিকা : বাঙালি দর্শন তথা সমগ্র ভারতীয়

উপমহাদেশের দার্শনিক চিন্তা চেতনায় চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন একটি ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী। ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একমাত্র চার্বাকই বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শন সম্পর্কে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ পাওয়া না গেলেও এ দর্শন যে অতি প্রাচীন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, বেদ, রামায়ণ, মহাভারত মহাকাব্যে এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যের নানা স্থানে। এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাঙালি দর্শনও অতি প্রাচীন বিধায় এ দর্শনে চার্বাক দর্শনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাঙালি দর্শনে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের গুরুত্ব: হাজার বছরের ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু-অহিন্দু নির্বিশেষে সকল শ্রেণির বাঙ্গালী চিন্তাবিদদের দ্বারা যে দার্শনিক চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে তাই বাঙ্গালী দর্শন। বাঙ্গালী দার্শনিক চিন্তাচেতনার সর্বস্তরে ভারতীয় সব ধরনের দার্শনিকদের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। যদিও সুস্পষ্টভাবে কোন গ্রন্থে বাঙ্গালী চিন্তায় চার্বাকদের গুরুত্বের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, তথাপি দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই বাঙ্গালীরা চার্বাকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সে দিকগুলো নিম্নরূপ:

আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা: বাঙ্গালী দর্শনে আধ্যাত্মিকতার চরম রূপ আবার এর চরম বিরোধিতা দেখা যায়। বিরোধিতার যে ধারা তা অনেকটাই পাওয়া গেছে চার্বাকদের কল্যাণে। যারা ভারতবর্ষকে আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান বলে মনে করেন, চার্বাক দর্শন তাদের মতের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত বিদ্রোহস্বরূপ। চার্বাকরা মনে করতেন এ বিশ্বজগতে কোন আধ্যাত্মিক সত্তা নেই। আমাদের মাঝে আধ্যাত্মিক সত্তার যে ধারণা আছে তা আমাদের মধ্যে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের মতোই কারো দ্বারা। তারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আমাদের মাঝে এসব ধারণা প্রোথিত করেছেন।

বস্তুবাদের জয়গান: আজকাল আমরা বাঙ্গালী দর্শনে বস্তুবাদের যে বিজয় পতাকা দেখতে পাই, ভারতের প্রাচীন চার্বাক দর্শন ছিল তার অগ্রদূত। এ কথা স্বীকার করতে কারো কোন বাধা নেই যে বাঙ্গালীর চিন্তা ও মননে, কর্ম ও সাধনায় যদিও অধ্যাত্মবাদ ছিল প্রায় অপ্রতিহত, তবুও এ সনাতন চিন্ত ায় চার্বাকরা এমন ধারণার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, যার ফলে বাঙ্গালীরা (কিছুসংখ্যক) চলে যায় প্রচলিত বিশ্বাস ও দর্শনের বিপরীত মেরুতে।

মানব সমীক্ষা: বাঙ্গালী দর্শনে মানব সমীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর আলোচনার ধারা সৃষ্টির ক্ষেত্রে চার্বাকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের উৎপত্তি ও তার জীবনাদর্শসহ সমগ্র মানব পরিস্থিতি চার্বাক দর্শনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য অনেক সমস্যার মতো মানুষের উৎপত্তি বিষয়ক প্রকল্পটিও চার্বাক দর্শনে জড়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চার্বাক দার্শনিকদের মতে ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ এই চারটি শাশ্বত জড়োপাদানের মাধ্যমেই মানুষের উৎপত্তি হয়েছে। চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার বাঙ্গালী দার্শনিকদের একটি ধারা চার্বাকদের ন্যায় চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। চার্বাকরা মনে করতেন, যতদিন দেহ আছে ততদিন চেতনা আছে। দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে চেতনারও অবসান ঘটে। তাই আত্মা বা চেতনা দেহেরই ধর্ম। দেহের অনুপস্থিতিতে আত্মা বা চেতনার কল্পনাও করা যায় না। চার্বাকদের এ মতবাদই দেহাত্মবাদ নামে পরিচিত যা পরবর্তীতে বাঙ্গালী দর্শনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

মানব জীবনের পরম লক্ষ্য: চার্বাক দর্শনে সুখ অর্জনকেই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা মনে করেন, সুখের অনুসন্ধান এবং তা অর্জনই মানবজীবনের নৈতিক আদর্শ। যে যত বেশি সুখ অর্জন করবে সে তত বেশি ভালো। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, জগতে অব্যাহত সুখ অর্জন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। দুর্ভোগমুক্ত অবিমিশ্র সুখের অস্তিত্ব এ জগতে নেই। সুখ সম্পর্কিত চার্বাক এ চিন্তাও 'বাঙ্গালী দার্শনিক চিন্তায়। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রাচীন ধারা হিসেবে চার্বাক দর্শন এ উপমহাদেশের সব দার্শনিক চিন্তায়ই কোন না কোনভাবে প্রভাব ফেলেছে। বাঙ্গালী দর্শনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাঙালি কিছু দার্শনিক চিন্তাধারায় চার্বাকদের। কোন গুরুত্ব না থাকলেও এর এক বিরাট অংশ চার্বাকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল এবং এখনও আছে। তাই বাঙ্গালী দর্শনে চার্বাকদের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

No comments:

Post a Comment

চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি?

 প্রশ্ন - ১২: চর্যাপদের সহজিয়া দর্শন কি? উত্তর: বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ বা চর্যাগীতি। চর্যাপদের পদগুল...